[১: একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ]
একবার ‘হিসাব রক্ষক’ পদে একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। অনেক ঝাড়াই-বাছাই শেষে তিনজন আবেদনকারীকে ভাইভা বোর্ডে আমন্ত্রন জানানো হয়। যাদের মধ্যে ছিলেন একজন গণিতবিদ, একজন হিসাব রক্ষক এবং একজন অর্থনীতিবিদ। প্রথমে গণিতবিদের পালা। তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো –
১+১ = কত?
এ আবার কেমন প্রশ্ন – জিজ্ঞাসা করলেন গণিতবিদ। এ তো সহজ – ১ + ১ এ ২ হবে।
এর পর হিসাব রক্ষকের পালা। তাকেও জিজ্ঞাসা করা হলো –
১+১ = কত?
হিসাব রক্ষক জবাব দিলো – ১+১ = ২ । তবে আপনি চাইলে ১০ থেকে ১৫% এদিক-ওদিক করে দিতে পারব।
সব শেষে এলেন অর্থনীতিবিদ। তাকেও একই প্রশ্ন –
১+১ = কত?
প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগে অর্থনীতিবিদ চেয়ার ছেড়ে উঠে প্রশ্নকর্তার কানের কাছে গিয়ে ফিস-ফিস করে জিজ্ঞসা করলেন
– স্যার, আপনি কত চান?

[২: ব্যর্থ ভালবাসার গল্প]
ছাত্র জীবনে পড়া অবস্থায় অর্থিনীতি সাবজেক্ট এর প্রেমে পড়েগিয়েছিলাম। অর্থিনীতি আমার কাছে শুধু কিছু রস-কষ হীন গ্রাফ আঁকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। কোন না কোন ভাবে এই নিরস গ্রাফগুলোর মাঝে আমি অদ্ভূত সুন্দর দর্শন খুঁজে পেয়েছিলাম। এই খুঁজে পাওয়ার পেছনে অন্তত পাঁচ জন মানুষের অবদান আছে। ওনারা হলেন – ক্যাম্পবেল আর. ম্যাকননেল, স্ট্যানলি এল. ব্রু, শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগণ – মনতোষ চক্রবর্তী, ইমরানুল হক , এবং মাহমুদুল হাসান ফৌজি।
‘একজন মানুষ সুযোগ থাকা সত্বেও কখন চুরি করবে আর কখন করবে না’ – এমন অদ্ভুতুড়ে প্রশ্নেরও যুতসই ব্যখ্যা আছে অর্থনীতিতে। যবে থেকে এই সৌন্দর্য উন্মোচন করতে পেরেছি, আমি শুধু খুঁজে বেড়িয়েছি নীরস গ্রাফের আড়ালে লুকিয়ে থাকা দর্শনের গল্প।
ফলশ্রুতিতে ৪/৫ টা অর্থনীতি কোর্সের মধ্যে থেকে একটা কোর্সের A+ মিস হয়ে যায়। কারন, পরীক্ষার খাতায় শুধু দর্শনের গল্প লিখলেই A+ পাওয়া যায় না। সবগুলো গ্রাফের অঙ্কও সমাধান করে আসতে হয়।
পরীক্ষার রেজাল্ট দেখে যেদিন জানতে পারলাম – প্রিয় অর্থনীতিতে আমি A+ পাইনি সেদিন খুব ক্ষোভ হয়েছিল। চারপাশে আমি অন্ধকার দেখছিলাম।
একই অভিজ্ঞতা হয়েছিলো ‘মার্কেটিং রিসার্স’ কোর্সে। বন্ধুদের মধ্যে আমিই প্রথম মার্কেটিং এ গবেষণাপত্র প্রকাশ করি। কিন্তু আক্ষেপের বিষয় কি জানেন? ‘মার্কেটিং রিসার্স’ কোর্সেও আমার A+ মিস হয়েছিলো।
আমি পাগলের মত ভালবাসতে জানি। কিন্তু প্রায়ই নিয়তি আমাকে একটা খুঁত ধরে হারিয়ে দেয়। এটা প্রায়ই হয়।
Moral of the story:
ভালবাসারা (হয়ত) নিখুঁত হয় না।
(হয়ত) ভালবাসলেই মন পাওয়া যায় না।
[৩: জর্জ বুলের বিয়ে]
যাই হোক, আড়ালে লুকিয়ে থাকা দর্শনের গল্প খোঁজার প্রয়াসটা শুরু হয়েছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার অনেক আগেই। একাদশ শ্রেণীতে প্রথম যখন জর্জ বুল এর বুলিয়ান এলজেব্রা পড়তে শুরু করি তখন অবধারিত ভাবে সবার মতই আমারও খটকা লাগে ১+১ এ কেমন করে ২ না হয়ে এক হয়। শিক্ষক তখন ডিজিটাল সার্কিট এর On & Off দিয়ে বুলিয়ান যোগের ব্যাখ্যা করেছিলেন।
কিন্তু দর্শনের গল্প খুঁজতে থাকা আমি আরো কিছু জানতে উৎসুক ছিলাম। নিউটনের মাথায় আপেল পড়ার মতই জানতে চেয়েছিলাম – জর্জ বুল ঠিক কোন উপলব্ধি থেকে শুধু শুন্য আর এক দিয়ে গণিতের জগতে নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করার ব্রত নিয়েছিলেন। জানতে পারলাম – এত দিন সংখ্যা দিয়ে আমরা শুধু কোন কিছুর কম/বেশী পরিমান পরিমাপ করতাম। কিন্তু বুল সংখ্যাতত্ব দিয়ে কোন কিছুর পরিমান নয় বরঞ্চ কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ের চরিত্র/অবস্থা কে ব্যাখ্যা করেছেন।
এবার বুলিয়ান এলজেব্রাকে কম্পিউটার লজিকের বাহিরেও প্রয়োগ করতে চাইলাম। ভাবলাম –
শুন্য যদি ”রাত” হয় তবে এক হচ্ছে ”দিন”।
শুন্য যদি “মৃত্যু” হয় তবে এক হচ্ছে “জীবন”।
শুন্য যদি “ভালবাসি না” করা হয় তবে এক হচ্ছে “ভালবাসি”।
অর্থাৎ জর্জ বুলের গণিত অনুযায়ী – একজন মানুষ হয় ‘বেঁচে আছে’ এই কথাটা সত্য, আর নতুবা মানুষটা ‘মরে গেছে’ এই কথাটা সত্য। সরকারী জন্ম-মৃত্যু রেজিষ্ট্রিতে একজন মানুষ একই সাথে জীবিত এবং মৃত হতে পারে না।
ঠিক তেমন ভাবে, কেউ একজন আমাকে হয় ভালবাসে আর নতুবা ভালবাসে না এর যে কোন একটা কথা সত্য। প্রেম-ভালবাসায় বুলিয়ান গণিতের প্রয়োগ দেখে আমি পুলকিত হলাম। ভাবতে লাগলাম, যদি –
আমি কোন মেয়েকে ভালবাসি ,
আর সে মেয়েটাও যদি আমাকে ভালবাসে,
তাহলে জর্জ বুলের তত্ব অনুযায়ী ১+১ = ১ হওয়ার কথা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমরা তো দু’জন মানুষ? তাহলে দু’য়ে মিলে এক হই কিভাবে?
তখন মনে পড়ল বিয়ের মন্ত্রের কথা –
"যদেতৎ হৃদয়ং তব, তদস্তু হৃদয়ং মম। যদিদং হৃদয়ং মম, তদস্তু হৃদয়ং তব"
অর্থাৎঃ তোমার হৃদয় আমার হোক। আমার হৃদয় হোক তোমারি।
[ ৪: ফাজি লজিকের ফাঁপড়]
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে বন্ধুদের ভালবাসার গল্প শুনতাম।এক তরফা ভালবাসার গল্প, যেখানে একজন ভালবাসে অথচ অপরজনের ভালবাসা শুন্যের কোঠায়। দুতরফা ভালবাসার গল্প, যেখানে দু’জনই দু’জনকে ভালবাসে। জর্জ বুলের একে একে এক মিলে যাচ্ছে। ভালবাসে অথবা ভালবাসে না এমনসব পরিস্থিতি।
কিন্তু মহা ফাঁপড়ে পড়লাম তখনই যখন ভালবাসার গল্পে অভিমান আসতে শুরু করলো।
অভিমান এক আজিব কিসিমের জিনিস। এর বাহিরে থাকে কর্কশ রুক্ষতা অথচ ভেতরে থাকে পূর্ণ ভালবাসা।
খটকা লাগলো। কারন , এবার আর জর্জ বুলের এলজেব্রা কাজ করছে না। বুলিয়ান গণিতে ‘ভালবাসি’ অথবা ‘ভালবাসি না’ কেবল এই দুই পরিস্থিতিই সত্য। ‘ভালবাসি অথচ অভিমান করে মাঝ দরিয়ায় আছি’, এমন পরিস্থিতির কোন ব্যাখ্যা সেখানে নাই।
কি ব্যাপার? গণিতবিদরা কি তাহলে এমন পরিস্থিতির ব্যাপারে কিছুই বলে যান নি?
নাহ্, এমন তো হওয়ার কথা নয়। উত্তর খুঁজতে থাকলাম। জানতে পারলাম এম আই টি’র মেধাবী প্রফেসর লতফি যাদে’র ফাজি লজিকের তত্ব।
যদি প্রশ্ন করা হয় ‘এখন কি রাত?’ তবে বুলের বাইনারী ব্যবস্থায় উত্তর হবে – ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’; অন্যদিকে, ফাজি লজিকে হ্যাঁ অথবা না ছাড়াও আরো উত্তর হতে পারে – মধ্যরাত, শেষরাত, সুবহে সাদিক ইত্যাদি।
ভালবাসার গল্পে এর মানে হচ্ছে – ‘তুই আর আমাকে ফোন দিবি না’ বলে যদি আপনার বয়ফ্রেন্ড আপনাকে ব্লক করে রাখে তবে সেদিনই আপনি ‘সব শেষ’ মনে করে মন খারাপ করে আরেকটা বয়ফ্রেন্ড খুঁজতে যাবেন না। আপনি বরং ধৈর্য্য ধরুন। সে কেন অভিমান করেছে কারন খুঁজে বের করুন। এরপর উদ্ধারকারী জাহাজ সহ নিজে গিয়ে মাঝ দরিয়া থেকে তাকে টেনে-হিঁচড়ে তুলে নিয়ে আসুন। তারপর ভেঙ্গে যাওয়া বাইনারী লজিক আবার মিলিয়ে নিন –
১ + ১ = ১
আর প্রস্তুত হন সেট তত্বের সমীকরণ এবং ঐ অর্থণীতিবিদ হিসাব রক্ষকের জন্য যিনি পাল্টা জিজ্ঞসা করেছিলেন – ‘স্যার, আপনি কত চান’।
(ভালবাসায় সেট তত্বের গল্প আরেকদিন করব)
You must log in to post a comment.