বলা হয়ে থাকে খাবারের মৌলিক স্বাদ না-কি ছয় টি – টক, ঝাল, মিষ্টি, লবণ, তিক্ত আর চর্বি। বৌভাতের আমিষ থেকে মন্দিরের নিরামিষ – সকল খাবারই এই ছয় স্বাদের পারমুটেশন-কম্বিনেশন।
কিন্তু আমার মনে হয় এই ছয়ের বাহিরেও আরো একটা স্বাদ বাকী থাকে। খাবার শেষ করে যখন পরিতৃপ্তির আভা সমস্ত মুখ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে তখন তার পেছনে আরো একটা স্বাদ কাজ করে। এটাকে বলাহয় সপ্তম স্বাদ।
কী সেটা?
ছোট্ট তিনটি ঘটনা বলি।
[২০০৬ সাল ]
বড় দিদির বাড়ীতে গিয়েছিলাম ইউনিভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষা দিতে। ওটাই আমার প্রথম যাওয়া। তিন দিন থেকেছিলাম। ফিরে আসার আগের দিন দুপুর বেলা দিদি হুলস্থূল কাণ্ড বাঁধিয়ে দিয়েছেন। খাবার টেবিলে বসার পর চেয়ে দেখি লাইন ধরে একটার পর একটা খাবার আসছেই।
টের পেয়েছিলাম, আগের রাত থেকেই প্রস্তুতি চলছিল। কিন্তু এত কিছু যে হবে আমি ভাবতে পারিনি। যাই হোক – খেতে বসেছি আমি একা। দিদি আমার সাথে আর কাউকে বসতে দেয় নি। এবং সেদিন আমার আগে কেউ খায়ও নি। শুধু দিদি আমার সামনে বসে আছে। নারকেল চিংড়ি, ভাপা ইলিশ, কয়েক পদের ভাজা মাছ, কয়েক রকমের ভর্তা, আর মুরগী।
আমি মূলত মুরগী পছন্দ করি না। কিন্তু, আমি জানিনা সেদিন দিদি কিভাবে এটা রান্না করেছিল। শুনেছি টক দই আর কি কি যেন মিশিয়ে ছিল। আমি শুধু একটা কথাই বলতে পারি – আজ অব্দি আমার জীবনে সর্ব শ্রেষ্ঠ রান্নাটা খেয়েছিলাম আমি সেদিন। এর পর থেকে আজ পর্যন্ত কোথায়ও এমন মুখে লেগে থাকা স্বাদের মুরগী রান্না আমি খুঁজে পাইনি।
খাওয়ার সময় দিদি কেমন করে যেন বুঝতে পেরেছিল । ফুরিয়ে গেলেই জিজ্ঞাসা করত –
“আর একটু খাবি ভাই? আর একটু দেই?”
আজ ১১ বছর পরও আমার কানে স্পষ্টভাবে দিদির ঐ কণ্ঠ শুনতে পাই। আমি আত্মহারা হয়ে খেয়েছিলাম। আর সারাটা সময় দিদি আমার সামনে বসে থেকে আমার খাওয়া দেখেছিল। ঐ দরদ জড়ানো কণ্ঠ, আর মায়া ভরা শীতল চোখের চাহনি আমি কোনদিনও ভুলব না। কোন দিন না।
[২০১৬ সাল]
১৪২২ বঙ্গাব্দ, পহেলা বৈশাখ
এই গল্পের মানুষটা আমার বৌদি। আমার দেখা খুব অসাধারণ মেয়েদের মধ্যে একজন। সেটা তার আন্তরিকতা, মূল্যবোধ, মেধা, কাজের ধরন, অনেক কিছু মিলিয়েই। আমাদের ঘরে এসেছেন আজ প্রায় ছয় বছর। গত ছয় বছর ধরেই আমি যতবার চাঁদপুর যাই, উনি আমার জন্য কিছু না কিছু রান্না করেন। আর বিশেষ অনুষ্ঠানে, বিশেষ আয়োজনে আমিই থাকি প্রধান অতিথি। গত বৈশাখে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। খেতে বসেছি। খাওয়া শেষ হয়েগেছে, উঠব। কিন্তু তখনও আরো দুইটি পদ খাওয়া বাকী। নিতে চাইনি, কিন্তু তবুও জোর করে প্লেটে ঢেলে দিলেন। আমি হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম কতক্ষণ।
বললাম – গলা অব্দি খেয়েছি, আর যায়গা নেই।
কিন্তু কে শোনে কার কথা। উনি একটা অদ্ভুত কাণ্ড করেলেন। যা দেখে না হেসে পারলাম না। এতক্ষণ উনি পরিবেশন করছিলেন। এবার চেয়ার টেনে আমার সামনে এসে বসলেন। বললেন – আমি আপনাকে গল্প শোনাই, আপনি গল্প শুনতে-শুনতে খেতে থাকেন। এর পর শুরু করল রাজ্যের গল্প। হাসতে-হাসতে কখন যে খাওয়া শেষ হয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না।
বৌদির কাছেই শোনা, সংসারে বউদের না-কি দুইটা রূপ হয় – পত্নী রূপ আর মাতৃ রূপ।
আমি এক অর্থে অনেক সৌভাগ্যবান। মাতৃ রূপ নিয়ে আমাদের সংসারে একজন বউ এসেছে।
আমি প্রায়ই একটা কথা বলি, এটা নিজস্ব অনুধাবন থেকে বলা – ‘খাবারের পাতে প্রেম এবং সংঘাত উভয়েরই জন্ম হয়“। কোন পাতে প্রেমের জন্ম হবে, আর কোন পাতে সংঘাতের – সেটা নির্ভর করে ব্যক্তির অভিপ্রায় থেকে।
সেদিনও খাওয়ার সময় দিদির কথা মনে পড়ল। বুঝতে পারলাম – কতটা স্নেহ ছিল সেদিনের রান্নায়। আরো বুঝলাম – রান্নার সপ্তম স্বাদ কোনটি।
এক কাপ চা
আরেকটা গল্প বলি। সেটা অনেক আগের। আমার তখনও চা খাওয়ার অভ্যাস গড়ে উঠেনি। আমার আরেকটা বোনের গল্প। সকাল বেলা ওদের বাসায় গেলাম। জানালা দিয়ে সকালের সূর্যের আলো আসছিলো। বোনটা তখন কেবল মাত্র শৈশব থেকে কৈশোরে পা দিয়েছে। আমাকে বললো – বস, তোমাকে চা বানিয়ে দিই। তার কিছুক্ষণ পর সে দুই কাপ চা নিয়ে হাজির। ফ্লোরে বসে আমি সূর্যের আলো দেখছিলাম, আর সে এক কাপ চা হাতে দিয়ে আমার পাশে বসলো। আমি চা’য়ের দিকে তাকিয়ে বললাম

– আমি রং চা খাই না।
– খাও, ভালো লাগবে।
এক চুমুক দেওয়ার পর আমি বললাম – ইয়াক , চিনি কম। সে উঠে গিয়ে চিনি মিশিয়ে দিলো।
কী যন্ত্রণা ! আমি এবার বললাম – ধ্যাত, এইসব হাবিজাবি জিনিস মানুষ কিভাবে খায় ☹️
এবার সে একটু বিরক্ত হয়ে বললো –
এত ঢং করছো কেন?
সেদিন আমি তার মুড নষ্ট করে দিয়েছিলাম। জিদ করে আমার পাশ থেকে উঠে গিয়েছিলো।
আজ এত বছর পরে আমি যখন পেছন ফিরে তাকাই তখন কেবলই মনে হয় – এত অভিযোগ আমি না করলেও পারতাম। আমি শুধু চায়ের কাপ দেখেছি, কিন্তু সেই কাপে জড়িয়ে থাকা অনুভূতিকে দেখিনি। দেখার সেই চোখ আমার তখনো হয়নি।
কী অপদার্থ আমি!
ছোট বেলা থেকেই আমাদের সংসারে সংগ্রাম ছিলো, কিন্তু প্রেমর ঐশ্বর্যও ছিলো। আমি ভালোবাসা পেয়ে বড় হয়েছি। আমি অনেক ছোট। তখনও স্কুলে ভর্তি হইনি। আমার এক দাদু ছিলো, যিনি শেষ বয়সে দৃষ্টি-শক্তি হারিয়েছিলেন। কিন্তু এই মানুষটা অদ্ভুত ভাবে আমার মাথায় ও গালে হাত বুলিয়ে আমাকে চিনতে পারতেন, আমি নিঃশব্দে ওনার সামনে এসে দাঁড়ালেও। বড় হয়ে শুনেছি – দু’জন মানুষের মধ্যে ভালবাসার জন্ম হলে না-কি একটা অদৃশ্য অনুভূতি তৈরি হয়। যেই অনুভূতি প্রায় নিখুঁত ভাবে বলে দিতে পারে – তোমার প্রিয় মানুষটা তোমার কাছে আছে কি-না, আজ তার মন ভাল আছে কি-না, তার সম্ভাব্য বিপদ, কিংবা কোন ভাল সংবাদ। অন্তর-আত্মার যোগাযোগটা এমনই। আমার জীবনে এমন অভিজ্ঞতা প্রায়ই হয়েছে। আমার আরেকজন দাদু ছিল ছেলেবেলায় যার কাঁধে করে আমি প্রতি হাঁট বারে বাজারে ঘুরে বেড়িয়েছি। তিনি আমাকে চকলেট কিনে দিতেন। তখন ১ টাকায় চারটি চকলেট পাওয়া যেত। চারটি চকলেট পাওয়ার পরে আমি তিনটি রেখে দাদুকে আবার একটি দিতাম। এরপর গালের এক পাশে চকলেট চুষতে-চুষতে আমরা হাঁট থেকে ফিরে আসতাম।
এখন আর আমি এক টাকার চারটি চকলেট খাই না। অস্ট্রেলিয়া থাকতে বেলজিয়ামের বিখ্যাত চকলেট ব্র্যান্ড ‘গাইলিয়ান’ এর সী শেল চকলেট বক্স কিনেছিলাম ২০ ডলার দিয়ে। দেশী টাকায় যার মূল্য প্রায় ১,২০০ টাকা।
২৬/২৭ বছর আগে ১ টাকায় চারটি সস্তা চকলেট খাওয়া আমি এখন ১,২০০ টাকার বিশ্ববিখ্যাত ব্র্যান্ড এর চকলেট কেনার সামর্থ্য রাখি। কিন্তু দুঃখটা কোথায় জানেন?
এখন আর আমার দাদু বেঁচে নেই যার সাথে আমি চকলেট ভাগ করে খেতে পারি।
চকলেটের মিষ্টি স্বাদ এখনো আছে। আমি বলব – ইনোভেশন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল কোয়ালিটি কন্ট্রোল এর কারনে চকলেট এর স্বাদ আগের চাইতে আরো ভাল হয়েছে।
কিন্তু একটা স্বাদ ইন্ডাস্ট্রি কোন দিন দিতে পারবে না।
আর সেটাই হচ্ছে – স্বপ্তম স্বাদ।
পুনশ্চঃ
ভালবাসার মানুষ গুলো হারিয়ে যায়। হয় সময় তাদেরকে ছিনিয়ে নেয়, আর নতুবা অবহেলা। যেদিন থেকে এই সত্য অনুধাবন করতে শিখেছি সেদিন থেকে প্রতিজ্ঞা করেছি – ভালবাসার মানুষগুলোকে আগলে ধরে রাখব। যতটা পারি, যতক্ষণ পারি।
______________
Date: 13 April 2017
Updated: 17 November 2020
You must log in to post a comment.