বাংলাদেশের অধিকাংশ কোম্পানিতে কর্মী নির্বাচন এবং নিয়োগদানের বিষয়টি এখনো অবহেলিত। নিয়োগদানের ক্ষেত্রে সাদামাটাভাবে মৌখিক সাক্ষাৎকার অথবা লিখিত পরীক্ষাকে যথেষ্ট বলে বিবেচনা করা হয়। আর, যে কেউ এ থেকে উতরে উঠতে পারে। নির্বাচকদের (মানে, ইন্টার্ভিউ বোর্ডে যারা ইন্টার্ভিউ নেন) যে প্রশিক্ষণ দরকার, তা কখনোই চিন্তা করা হয় না। এবং আরো দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, অধিকাংশ কোম্পানির কোন কর্মী নিয়োগ বিধি নেই অথবা নির্বাচকদের কোন হ্যান্ডবুক নেই

এই ব্লগে আমি আলোচনা করব, আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা, কয়েকজন অভিজ্ঞ মানব সম্পদ ব্যবস্থাপকের সাথে আলোচনা, এবং সংশ্লিষ্ট কিছু পড়াশোনার উপর ভিত্তি করে আমাদের দেশীয় প্রেক্ষাপটে চাকরির সাক্ষাৎকার এবং নিয়োগ সংক্রান্ত কিছু ভুল-ত্রুটি এবং সীমাবদ্ধতা নিয়ে।

  1. অধিকাংশ কোম্পানির স্বচ্ছ কোন নিয়োগ নীতি নেই। ফলে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপক কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে কোন সঙ্গতিপূর্ণ পদ্ধতি (মানে, আগা-গোড়া মিল আছে এমন পদ্ধতি) অনুসরণ করেন না। এ জন্য প্রায়ই স্বজনপ্রীতি হয়ে থাকে। এতে করে কোম্পানির বর্তমান কর্মীরা অসন্তুষ্ট হয় এবং তারা দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ হয় না। 
  2. সাক্ষাৎকার এর ব্যাপারে অনেক ব্যবস্থাপক এখনো গা-ছাড়া ভাব দেখান। তারা ২০ জন প্রার্থীকে একই দিনে ডেকে সারা দিন অপেক্ষায় রাখেন, যা তাদেরকে বিরক্ত করে ফেলে। 
  3. দ্বিতীয়ত, একই দিনে ২০ জন প্রার্থীর মানসম্মত ভাবে সাক্ষাৎকার নেয়া সম্ভব নয়। একজন নার্স নিয়োগ দেয়া হলে আবেদনকারী ১৫ জনকে একই সময়ে ডাকা হয়। এর ফলশ্রুতিতে একটা মনস্তাত্বিক সমস্যা তৈরি হয়। দেখা যায় যে, এদের মধ্যে বেশ কয়েকজন থাকে যারা সিনিয়র লোক। তারা যে বর্তমান চাকরি ছেড়ে দিতে চাইছেন, সেটা জুনিয়রদের কাছে বা একই সেক্টরে কাজ করা অন্যদের কাছে প্রকাশ করতে চান না। তাই,  সাক্ষাৎকারের জন্য অপেক্ষা না করেই কয়েকজন তখনই চলে যান। বাকী আবেদনকারীকে লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার জন্য বলা হয়। কিছু সিনিয়র প্রার্থী এটা পছন্দ করেন না। তারাও চলে যান।

আমি একজন ম্যানেজারকে চিনি। সেদিন দু’জন Sales Executive নিয়োগের জন্য ১৫ জন প্রার্থীকে সকাল ১১ টায়  সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হয়েছিল। অথচ, সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে বিকেল ৫ টা বেজে গেলেও তাদের সাক্ষাৎকার নেয়া শুরু হয় নি। সহকর্মী হিসেবে আমি জানতে চাইলাম, প্রার্থীদেরকে এতক্ষণ অপেক্ষা করিয়ে রাখার কারন। তিনি একটা অদ্ভুত উত্তর দিলেন – Sales Executive দের প্রথমে যেটা পরীক্ষা করতে হয় সেটা হচ্ছে ধৈর্য্য। আমি প্রত্যুত্তর দিলাম, এই চাকরি প্রার্থীরা আপনার প্রতিষ্ঠানকে পছন্দ করবে কি-না এবং তারা আদৌ চাকরি করবে কি-না সেটা আপনি কিভাবে নিশ্চিত হলেন? আপনি যেমন প্রার্থী পছন্দ করছেন, প্রার্থীরও তো আপনাকে পছন্দ হতে হবে, তাই না?আর তা ছাড়া, এখানে বেশ কয়েক জন আছেন যারা ইতোমধ্যে অন্য প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তারা এক বেলা ছুটি নিয়ে এসেছেন। দেরীর কারনে ওনারা চলেও গেছেন। এমনও তো হতে পারে, ইতোমধ্যে আপনি একজন যোগ্য প্রার্থী হারিয়েছেন। আর তা ছাড়া, respect their time.


  1. এমনও হয় যে, ইণ্টার্ভিউ বোর্ডের সদস্যরা / প্রধান নির্বাচক (selector)  জানেন যে, তাকে এখন নার্স নিয়োগ দিতে হবে। অথচ, একজন নার্সের কাজের বিবরণী (Job Description) তার কাছে নেই এবং এই সম্পর্কে তার সম্যক ধারণাও নেই। এমতাবস্থায় একজন সঠিক আবেদনকারীকে বাছাই করা কঠিন।
  2. সাধারণত সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় প্রধানই ইণ্টার্ভিউ বোর্ডের প্রধান নির্বাচক (selector) হয়ে থাকেন। তিনি সিনিয়র ব্যবস্থাপক এবং খুব ব্যস্ত লোক। বাছাই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করার জন্য তার পর্যাপ্ত সময় নেই। ব্যস্তট্যাস্ত হয়ে তিনি সিলেকশন বোর্ডে আসেন। দ্রুত কয়েকটি প্রশ্ন করে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন যে, কাকে নিয়োগ দিবেন। ফলে, প্রায়সময়ই সঠিক ব্যক্তিটি নিয়োগ পান না।
  3. অনেক ব্যবস্থাপকই প্রার্থী বাছাইয়ের আগে সাধারণত কোন homework করেন না। আমি এমনও সাক্ষাৎকার দেখেছি যেখানে নির্বাচকরা জানেন না, প্রার্থীদের মাঝে তারা কি খুঁজছেন এবং তা কিভাবে পেতে হয়।

এই প্রসঙ্গে আমার একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। কোন একটি স্বাস্থ্য সেবা মূলক প্রতিষ্ঠানে আমাকে অনলাইন সাক্ষাৎকারের জন্য আমন্ত্রণ করা হয়। সৌজন্য পর্বের প্রথমে ইন্টারভিউয়ার যখন তার নাম বললেন তখন আমি বললাম – আমি আপনাকে চিনি। আপনার পেশা এবং পদবী এই। তিনি খুব আশ্চর্য হলেন। চাকরি প্রার্থী যে ওনাকে চিনে ফেলবে সেটা উনি প্রত্যাশা করেন নি।

মূলত, সেদিনের ইন্টার্ভিউ বোর্ডের একজন ছাড়া সবাইকে আমি চিনতাম। যাই হোক, আশ্চর্যের রেশ কাটানোর পরে ইন্টারভিউয়ার আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন – আপনি কি বর্তমানে অবসর আছেন এবং কাজের সুযোগ খুঁজছেন? প্রশ্নটা আমাকে খুব হতাশ করেছে। আমি পাল্টা জানতে চাইলাম – আপনার অফিস থেকে কি আমার সিভি আপনাকে দেয়া হয় নি? তখন তিনি তড়িঘড়ি করে আমার সিভির পাতা উল্টালেন। বুঝলাম, ইন্টারভিউয়ার কোন homework না করেই ইন্টার্ভিউ নিতে চলে এসেছেন।


  1. অনেক ইন্টার্ভিউ বোর্ডে নির্বাচককে closed question, leading question, এবং redundant question – ও জিজ্ঞাসা করতে দেখেছি। ফলশ্রুতিতে, প্রার্থীর কাছ থেকে সামান্য পরিমাণ তথ্যই জানা যায়। নির্বাচকদের ধারনা নেই যে, প্রার্থীর সাফল্য,আগ্রহ, দৃষ্টিভঙ্গি, কাজের অভিজ্ঞতা প্রভৃতি সম্বন্ধে মূল্যবান তথ্য পেতে open question, probing question, এবং reflective question জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে। প্রার্থী সম্বন্ধে ধারণা পাওয়ার জন্য এ ধরনের প্রশ্ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
  2. আমি একজন উচ্চপদস্থ ব্যবস্থাপককে দেখেছি দক্ষ কর্মীদের সাক্ষাৎকার নিতে। তিনি ইচ্ছে করেই এমন কঠিন প্রশ্ন করছেন যাতে তারা উত্তর দিতে না পারে। তারপর তিনি আবেদনকারীদের ভুল-ভ্রান্তি বা অজ্ঞতার সুযোগে তাদেরকে চরম ভাবে ঘাবড়িয়ে দিচ্ছিলেন। এটি একটি সেকেলে এবং বড়ই নিষ্ঠুর আচরণ যে, ৫/৬ জন্য বয়োজ্যেষ্ঠ এবং অভিজ্ঞ লোক selection board – এ বসে নবাগত এক প্রার্থীর ওপর এঁকের পর এক প্রশ্ন করছে। অথচ প্রার্থী আগে থেকেই nervous.
  3. এমনও হয় যে, নির্বাচক কোম্পানির ভিতরের এবং বাইরের লোকদের চাপে মাথা নত করে কম যোগ্যতার লোকদের নিয়োগ দেয়। স্বাভাবিকভাবেই, এ জন্য কোম্পানি দুর্ভোগ পোহায়। 

পরবর্তী ব্লগ

একটি ভাল চাকরির সাক্ষাৎকার কিভাবে নিতে হয় সেই সম্পর্কে জানতে পড়ুনঃ “How to conduct a good job interview”.

Stay current with advanced knowledge, professional skills, and industry insights. Sign up for our newsletter and never miss a thing.

%d bloggers like this: