অর্থনীতিতে একটা তত্ব আছে, ইংরেজিতে এর নাম Moral Hazard. বাংলায় বললে সম্ভবত নৈতিক ঝুঁকি।
একটা উদাহরণ দেই। “বীমা” ব্যবসায়ের প্রচলন হয়েছিল ব্যবসায় এবং ব্যক্তি জীবনের সম্ভাব্য ঝুঁকি হ্রাস করার জন্য। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল – কিছু-কিছু ক্ষেত্রে ঝুঁকি হ্রাস হওয়া দূরে থাক, উল্টো ঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়েছে। যেমন, গাড়ি চালকেরা বীমা না থাকলে সতর্কতার সাথে গাড়ী চালায়। কিন্তু বীমা থাকলে অনেকেই বেপরোয়া ভাবে গাড়ী চালায় আর মনে-মনে ভাবে যে দূর্ঘটনা হলে খেসারত দেবে বীমা কোম্পানি। এই ধরণের আচরণের ফলে – মহৎ উদ্দেশ্য ও বড় আশা নিয়ে শুরু করা বীমাকারী মুখ চুন করে হতাশ হয়।
মোরাল হ্যাজার্ড এর আরেকটা উদাহরণ হতে পারে স্কলারশিপ। অধিকাংশ স্কলারশিপের লক্ষ্য থাকে দরিদ্র এবং মেধাবী ষ্টডেন্টকে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য আর্থিক ভাবে সহায়তা করা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় – স্কলারশিপের জন্য এমনও কেউ আবেদন করে যে মেধাবী কিন্তু সেই অর্থে দরিদ্র নয়। উপরি ইনকাম কিংবা গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরার জন্য সে এই স্কলাশিপের আবেদন করে।
কি একটা অবস্থা।
এই ধরণের ঘটনা থেকে একটা কথা মোটামুটি প্রমাণ হয় যে – সুচিন্তা, ভালবাসা কিংবা মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কোন কাজ শুরু করলেই যে তার পরিনতি সবসময় আশাব্যঞ্জক ভাবে শেষ হবে, এমন টা নয়। ব্যক্তি ভেদে, মহৎ চিন্তা নিয়ে কোন কাজ শুরু করলেও মোরাল হ্যাজার্ড এর কারনে মাঝে-মাঝে পরিণতিতে চরম হতাশ হতে হয়।
মোরাল হ্যাজার্ড এর এই তত্ব শুধু অর্থনীতিতেই নয়, ব্যক্তি জীবনেও ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনাকে এই তত্ব দিয়ে ব্যখ্যা করা যায়। ধরুন কেউ একজন প্রেমে পড়ল। প্রিয় মানুষটাকে কোন একদিন সরল স্বীকারোক্তির মত সুন্দর করে সে জানিয়ে দিল – “আমি তোমাকে ভালবাসি। আমরা একসাথে সুখী হতে চাই, ভাল কিছু করতে চাই”।
এই ভালবাসি বলার পরে কেউ প্রত্যাখ্যান করবে। কিন্তু কেউ-কেউ আছে প্রত্যাখ্যান না করে জিইয়ে রাখবে। পুকুর থেকে তুলে আনা মাছকে যেমন পরে খাওয়ার জন্য জলের ঘড়ায় জিইয়ে রাখে, এটাও ঠিক তেমনই ষ্ট্রাটেজী। জিইয়ে রাখা মাছ যেমন মনে করে, আমি তো ভালই আছি, ঠিক তেমনভাবেই ঐ মানুষটাও ভাবে “আমার প্রিয় মানুষটা তো আমাকে ভালোই বাসে”। আর এইভাবেই সেই মানুষটা প্রত্যাখ্যাত হয় না কিন্তু কোকেন এর নেশার মত ভালবাসার ঘোরের মধ্যে থেকে exploited হয়।
অনেকটা সময় পর যখন সেই মানুষটা বুঝতে পারে s/he was exploited, তখন অনেকেই ফিরে আসে না। কেন আসে না তার সেই ব্যাখ্যাও অর্থনীতি, ব্যাবসায় এবং মনস্তত্বে আছে।আমি KISS নীতিতে বিশ্বাসী। তাই হুদাই “কেন ফিরে আসে না” এই ব্যাখ্যা দিয়ে আজকের আলোচনা জটিল করব না।আজ শুধু আলোচনা করব, exploited হচ্ছে বুঝার পর যারা ফিরে আসে তাদের সম্ভাব্য পরিণতি কি।
exploited হয়ে ফিরে আসার পর তার সামনে তিনটা পথ খোলা থাকে – ১) ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে নতুন ভাবে জীবন ধারণ করা, ২) আত্মহত্যা করা, ৩) প্রতিশোধ নেওয়া।
যে নতুন ভাবে বাঁচতে চায়, তাকে অভিনন্দন। যে আত্মহত্যা করে, তাকে সমর্থন করি না কিন্তু মরে গিয়ে সে একটা উপকার করে দিয়ে যায়। তাঁর মধ্যে পুঞ্জীভূত হওয়া বিষ বাষ্প অন্য কারো মাঝে আর সংক্রমিত হয় না।
কিন্তু প্রতিশোধ নেওয়ার ৩ নাম্বার অপশন টা দীর্ঘ মেয়াদে ভয়াবহ। কারন, প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ঐ মানুষটা নতুন কোন শিকার অন্বেষণ করতে থাকে। তার সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের প্রতিশোধ সে অন্য কারো উপরে নিয়ে যন্ত্রণা লাঘব করতে চায়। এই প্রতিশোধ যখন একজনের উপরে নিয়ে সফল হয়, তখন এক এ এক এ কাটাকাটি হয়ে প্রক্রিয়াটা গণিতের সমীকরণের মত বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা।কিন্তু বাস্তবে তা হয় না।
আমার মা প্রায়ই কথা প্রসঙ্গে বিভিন্ন প্রবাদ বলে। এর মধ্যে একটা হচ্ছে – “কচুগাছ কাটতে কাটতে একদিন ডাকাত হয়”। মা’কে এটা বলেছিল তাঁর মা। প্রাচীন এই প্রবাদ গুলো আমাদের অমূল্য সম্পদ। আমি এবং আমার কিছু বন্ধু আছে যারা ক্রিমিনলজি নিয়ে শখের পড়াশোনা করি। এর মধ্যে এক বন্ধু আছে যার ক্রিমিনলজি এনালাইসিস স্কিল বেশ ভাল। সে এটাকে রীতিমত শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এই তো, ক’মাস আগে আমেরিকায় এক বাংলাদেশী তরুণ ব্যবসায়ী খুন হয়। আমরা আলোচনা করছিলাম এই খুনের সম্ভাব্য মোটিভ কি হতে পারে। বন্ধু যেই মোটিভের কথা বলেছে, দু’দিন পরে পত্রিকার পর্যালোচনায় ঠিক সেই মোটিভটাই আমরা পেয়েছি।
যাই হোক, বলছিলাম কাটাকাটি হয়ে প্রক্রিয়াটা গণিতের সমীকরণের মত বন্ধ হয়ে (মিলে যাওয়ার) যাওয়ার কথা। কিন্তু মানুষের মনস্ত্বত্ব তো সরলরৈখিক লিনিয়ার ইকুইশন না। তাই প্রতিশোধের প্রক্রিয়াটা বন্ধ হয় না। ক্রিমিনাল সাইকোলজিষ্টরা এটাকে বলেন Escalation. কচুগাছ কাটতে-কাটতে ডাকাত হওয়ার মতই, একজনের উপর সফল হওয়ার পর সে আরেকজনের উপর এক্সপেরিমেন্ট করে। এভাবেই হাত পাকতে থাকে, অভিজ্ঞতা বাড়তে থাকে আর বাড়তে থাকে ফ্যান্টাসি। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় – “বাঘ যেমন নর মাংসের স্বাদ পায় … “।

এবং এভাবেই একটা Vicious Cycle বা দুষ্ট-চক্র তৈরি হয়। এটা অনেকটা কাউন্ট ড্রাকুলার চক্রের মত। উপন্যাসের ড্রাকুলা যেমন মিনা মুরের সাথে প্রেম করে, তাঁর রক্তপাণ করে তাকে পিশাচ বানিয়েছিল। পরে সেই মিনা মুর পিশাচিনী হয়ে সারা লন্ডনে ঘুরে-ঘুরে শিশুদের রক্ত পান করা ডাইনীতে পরিণত হয়েছিলো।
#School_of_Life
You must be logged in to post a comment.