অ্যাপলের পণ্যের গুণগত মান উন্নয়ন করার জন্য ষ্টীভ জাপানের সনি কর্পোরেশনের (SONY) চেয়ারম্যান এবং সহ-প্রতিষ্ঠাতা আকিও মরিতাকে অনুসরণ করতেন। প্রাক্তন সি ই ও জন স্কুলির সাথে ষ্টীভ প্রায়ই সনির হাই-টেক কারখানা পরিদর্শনে যেতেন। এমনকি, অ্যাপলের কারখানাগুলোও সনি দ্বারা অনুপ্রাণিত। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে স্কুলি বলেন, “স্টিভের পয়েন্ট অফ রেফারেন্স সেই সময়ে ছিল সনি। সে সনি হতে চেয়েছিল।”

একবার একটি ব্যবসায়িক ভ্রমণের সময় মরিতাকে ষ্টীভ জিজ্ঞাসা করেছিলেন – কেন কর্মচারীরা সবাই ইউনিফর্ম পরেন?

মরিতা ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, যুদ্ধের পরে জাপানিদের অর্থ সঙ্কট ছিল প্রচুর। পরার মত কাপড়ের অভাব ছিল। তাই, কোম্পানী ইউনিফর্ম প্রদান করা শুরু করল যাতে শ্রমিকরা লজ্জিত না হয়; এবং তাদের কাজের জন্য পরিধানযোগ্য পোশাকও থাকে।

ব্যখ্যাটি জবস এর মনোপ্লুত হয়। তিনি অ্যাপলের কর্মীদের জন্য ইউনিফর্ম প্রদান করার উদ্যোগ নেন। জাপানী ফ্যাশন ডিজাইনার ইসি মিয়াকে (Issey Miyake) এর উপর সেই দায়িত্ব অর্পন করেন। মিয়াকে অ্যাপলের কর্মীদের জন্য একটি জ্যাকেট ডিজাইনও করেছিলেন। কিন্তু বিধি বাম, আমেরিকান কর্মচারীরা এই ইউনিফর্ম এর ঘোর বিরোধিতা করে। তোপের মুখে জবস পরবর্তীতে ইউনিফর্মের ধারনা থেকে সরে আসেন। ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হয় ইউনিফর্ম বানানোর আইডিয়া।

তবে, ইউনিফর্ম না বানালেও, নিজের জন্য, তিনি মিয়াকে’কে একটি টার্টলনেক শার্ট, বেল্ট ছাড়া চাপা লেভির জিন্স এবং নিউ ব্যালেন্স স্নিকার্স পরা ডিজাইনের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এটি সহসাই তার ট্রেডমার্ক লুকে পরিণত হয়েছিল, যা তিনি বেশিরভাগ সময়, কাজের সময় এবং বাইরে পরতেন। মিয়াকে ষ্টীভের জন্য একশত শার্ট তৈরি করে তার ওয়ারড্রব ভর্তি করে ফেলে। ফলশ্রুতিতে, ষ্টীভের ওয়ারড্রোবটি হয় ফাংশনাল কিন্তু জেন দর্শনের মত সরলতায় ভরা এবং স্বতন্ত্র।

ইউনিফর্মের আইডিয়া কাজে না লাগলেও আকিও মরিতা এবং সনি থেকে ষ্টীভ অনেক কিছু শিখেছেন যা অ্যাপলের কর্পোরেট দর্শনের ভিত্তি প্রস্তর হিসেবে এখনো প্রতিষ্ঠিত। ২৫/২৬ বছর আগে মরিতা ষ্টীভ এবং জন স্কুলিকে সনি ওয়াকম্যান দিয়েছিলেন। সেই সময় এই প্রযুক্তি ষ্টীভ অথবা স্কুলি, কেউই দেখেনি। কিন্তু সনির ওয়াকম্যান দেখে ষ্টীভ মুগ্ধ হয়েছিলেন। ক্যালিফোর্ণিয়া ফিরে এসে ষ্টীভ প্রথম যে কাজটি করেছিলেন তা হল ওয়াকম্যানটিকে খুলে আলাদা করা এবং তিনি প্রতিটি অংশের দিকে তাকিয়ে থাকা। কীভাবে এটি তৈরি হয়েছিল, কিভাবে ফিটিং করা হয়েছিল এবং ফিনিশিং দেয়া হয়েছিল – এই সব কিছু খুঁটে খুঁটে পর্যবেক্ষণ করা। সার্বিক গুণগত মান এবং খুটি-নাটি বিষয়ে সনির প্রচেষ্টা ষ্টীভকে মুগ্ধ করে। মরিতা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে অ্যাপলের কর্পোরেট দর্শনে “পারফেকশন” প্রাধান্য পায়। বর্তমান সি ই ও টীম কুক’কে একদা বলেছিলেন –

“Details matter, it’s worth waiting to get it right.”

– Steve Jobs

সনি , ওয়াকম্যান, আকিও মরিতা, ইসি মিয়াকে এবং ষ্টিভ জবস … এই গল্পগুচ্ছতে অনেকগুলো লক্ষ্যনীয় ব্যাপার রয়েছে।

ইউনিফর্ম এর আইডিয়া একটা নির্দিষ্ট সময়ে যতটা প্রশংসনীয় হয়েছিল, ঠিক ততটাই নিন্দনীয় হয়েছে ভিন্ন দেশে, ভিন্ন সময়ে।

তাই, এই গল্পের ১ নং সারমর্ম হচ্ছে – সময়ের সাথে-সাথে আমাদের গ্রহণযোগ্যতার মানদণ্ডও পাল্টাতে থাকে।

বিপণনের কেতাবী ভাষায় আমদেরকে ট্রেন্ড, ফ্যাশন, ফেড … এই সব পড়ানো হয়।

ব্রিটিশ দাসত্বের আগে বাঙ্গালীদের পোশাক ছিল – ধুতি, লুঙী, ফতুয়া, পাঞ্জাবী, শাড়ী। আমার দাদু, ঠাকুমা তাই পড়তেন। সেটাই ছিল আমাদের ঐতিহ্য।

এর পর ব্রিটিশ দাসত্বের সময়ে বাঙালীরা শার্ট, প্যান্ট, স্যুট পরতে শুরু করল। এবং নতুন এই পোশাকের প্রতি বয়স্ক/বৃদ্ধরা বেশ কটাক্ষই করতেন। “বৃটীশ বাবু” বলে বিদ্রূপ করতেন হর-হামেশাই।

হাল আমলে আমেরিকান জিন্স-টি শার্ট এর প্রচলন শুরু হলো। And guess what?

এইবার শার্ট-স্যুট পরা (বাঙ্গালী) বৃটিশ বাবুরা হাল আমলের জিন্স-টি শার্টওয়ালা তরুণদেরকে ক্ষ্যাপায়।

মজার বিষয় হচ্ছে, শার্ট, প্যান্ট, স্যুটওয়ালারাও নিজের ঐতিহ্যকে ধারণ করছেন না; আবার জিন্স-টি শার্টওয়ালারাও না। অথচ এই দুই গ্রুপ নিয়মিত ভাবে এক দল আরেক দলকে হেনস্ত করার অদ্ভুত, এবং অপ্রয়োজনীয় কাদা ছোঁড়া-ছুঁড়িতে জড়িয়ে আছে।

ট্রেন্ড, ফ্যাশন, ফেড, সোশিও ইকোনমিক ট্রেণ্ড … এই সব শুধু ক্লাসেই পড়ানো হয় আর পরীক্ষার খাতায় বর্ণনা লিখে পৃষ্ঠা ভরাট করানো হয়। অর্থাৎ, বিদ্যা চোখ আর কান দিয়ে মাথায় ঢুকে, অন্তঃপর কলমের আগা দিয়ে বের হয়ে যায়। শিখে আসা বিদ্যা বাস্তব জীবনে ধারণ আর প্রয়োগ করা হয় না। ক্ষেত্র বিশেষে নিরুৎসাহিত করা হয়।

এই পর্যায়ে কবি তারাপদ রায়ের একটা কবিতার উল্ল্যেখ না করে পারছি নাঃ

আমরা যে গাছটিকে কৃষ্ণচূড়া গাছ ভেবেছিলাম
যার উদ্দেশ্যে ধ্রূপদী বিন্যাসে কয়েক অনুচ্ছেদ প্রশস্তি লিখেছিলাম
গতকাল বলাই বাবু বললেন, ‘ঐটি বাঁদরলাঠি গাছ’।
অ্যালসেশিয়ান ভেবে যে সারমেয় শাবকটিকে
আমরা তিন মাস বক্‌লস পরিয়ে মাংস খাওয়ালাম
ক্রমশ তার খেঁকিভাব প্রকট হয়ে উঠছে।
আমরা টের পাইনি
আমাদের ঝরণা কলম কবে ডট্‌ পেন হয়ে গেছে
আমাদের বড়বাবু কবে হেড অ্যসিস্ট্যান্ট হয়ে গেছেন
আমাদের বাবা কবে বাপি হয়ে গেছেন।
আমরা বুঝতে পারিনি
আমাদের কবে সর্বনাশ হয়ে গেছে।

২ নং সারমর্মঃ একটা কোম্পানি অথবা ব্যক্তি মানুষ অথবা কোন সমাজিক দলের physical infrastructure এর চাইতে philosphical architecture অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ।

৩ নং সারমর্মঃ Always follow someone. And follow with your heart. আকিও মরিতাকে যখন ষ্টীভ অনুসরণ ( আমি বলি অন্তরে ধারণ করা) করতে শুরু করেন তখন মরিতার কাছে ষ্টীভ নেহায়েৎ নস্যি। কারন, মরিতা ততদিনে বিরাট ধনী এবং ৪০ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ঝানু ব্যবস্যায়ী। আর ষ্টীভ মাত্র ফিডার ছেড়ে আসা সেদিনকার ছোকরা। কোথায় আগরতলা, আর কোথায় খাটের তলা! কিন্তু তাতে কি হয়েছে? ষ্টীভ মরিতাকেই অনুসরণ করতেন।


in categories

Stay current with advanced knowledge, professional skills, and industry insights. Sign up for our newsletter and never miss a thing.

%d bloggers like this: